নিজ¯^,প্রতিনিধিঃ
নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার নিল¶া ইউনিয়নের দিনমুজুর সুমেদ আলী এখন টেঁটা সর্দার । পুরোনো নরসিংদীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক জনপদের নাম নিল¶া। এই জনপদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি ও প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। চরাঞ্চল হলেও সাম্প্রতিক সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে অনেকটাই এগিয়েছে এই জনপদ। শি¶া, চাকরি ও ব্যবসা ¶েত্রেও পিছিয়ে নেই তারা। বেশ কিছুদিন আগে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়েছে এলাকাটি। কিন্তু পান থেকে চুন খসলেই টেঁটা নিয়ে মরণ যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে এখানকার মানুষগুলো। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই টেঁটাযুদ্ধ যেন এলাকাবাসীর অভিশাপ হয়ে
দাঁড়িয়েছে। এ যুদ্ধে যেমন প্রাণ গেছে অনেকের, তেমনি অন্ধকার নেমে এসেছে এখানকার অসংখ্য মানুষের জীবনে। সরেজমিনে জানা গেছে, কয়েকজন দাঙ্গাবাজের কারণে যুগ যুগ ধরে অশান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে নিল¶া ইউনিয়নের সাতটি গ্রামে। দিনের পর দিন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘর্ষে প্রাণহানি, পঙ্গুত্ববরণ ও অর্থনৈতিকভাবে নিঃ¯^ হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে অনেককে। আর এসব ঘটনার জের ধরে চলমান মামলা ও বিরোধ নিয়ে নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে জটিলতার। আর এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে সমাজপতির মুখোশধারী একটি শ্রেণি। বিবদমান দলের মধ্যে সমঝোতার নামে তারা চালান বাণিজ্য। যে কারণে দ্বন্দ্ব অবসান হওয়ার পরিবর্তে যুগ যুগ ধরে মাছ শিকারে ব্যবহৃত টেঁটার ব্যবহার হচ্ছে মানুষ নিধনের হাতিয়ার হিসেবে। আর সে হাতিয়ার বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন ওই এলাকার এক সময়ের দিনমজুর। তিনি এখন নিল¶ার লাঠিয়াল সর্দার হিসেবে পরিচিত। নাম তাঁর সুমেদ আলী। কে এই সুমেদ আলী?
নিল¶া ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের মৃত মন্নর আলীর ছেলে সুমেদ আলী। নেই কোনো অ¶র জ্ঞান। আজ থেকে ১৫-১৬ বছর আগে তিনি ছিলেন হরিপুর গ্রামের এক ব্যক্তির বাড়ির দিনমজুর। সেখান থেকে যা অর্থ পেতেন তা দিয়ে কোনো রকমে চলত সংসার। পরে গোপীনাথপুর গ্রামের কয়েকজন জেলের সঙ্গে মেঘনা নদীতে মাছ শিকারের কাজ শুরু করেন। মাছ শিকারি থেকে হয়ে যান টেঁটা দিয়ে মানুষ শিকারি। মাছ শিকারের পাশাপাশি তখন থেকেই ভাড়াটে লাঠিয়াল ও টেঁটা শিকারি হিসেবে কাজ শুরু করেন। লাঠিয়াল হিসেবে ভাড়া খাটাবাবদ নির্দিষ্ট অর্থ পেতেন সুমেদ আলী। এ ছাড়া মারামারির সময় লোকজনের বাড়ির মালামাল লুট করতেন। সেই অর্থ জমা করতে করতে তিনি এখন নিল¶ার লাঠিয়াল সর্দার। নিল¶ার একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, সুমেদ আলীর ইশারায় এখন নিল¶ায় সব টেঁটাযুদ্ধ চলে। আর যারা তার কথা মতো টেঁটাযুদ্ধে অংশ নিতে রাজি না হয় তাদেও দিতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদা। এক সময়ের দিনমজুর এখন কোটিপতি বলে একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন। বর্তমানে তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যাসহ ১৪টি মামলা। যেভাবে শুরু হয় সুমেদ আলীর উত্থান ২০১২ সালে ২১ অক্টোবর। নিল¶ার গোপীনাথপুর গ্রামের জজ মিয়া ও রহিম মিয়া নামের দুই চাচা-ভাতিজার মধ্যে জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে সালিশ বৈঠক বসে। এ সময় জজ মিয়ার সমর্থক আবদুল হেকিমকে প্রতিপ¶রা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। সালিশকারীরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত রহিমের সমর্থক নয়জনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে পাশের হরিপুর, দড়িগাঁও, সোনাকান্দি, বীরগাঁও ও আমিরাবাদসহ নিল¶ার সাতটি গ্রামে। একপর্যায়ে রহিমের প¶ে লাঠিয়াল বাহিনীতে যোগ দেয় সুমেদ আলী। এরপর গত তিন বছরে দুই প¶ের কয়েক দফা সংঘর্ষে টেঁটাবিদ্ধ হয়ে দড়িগাঁও গ্রামের রইস আলী ও কদম আলী, হরিপুর গ্রামের মামুন ও গোপীনাথপুর গ্রামের আব্দুল হেকিম নিহত হন। এ পর্যন্ত অগ্নিসংযোগ করা হয় প্রায় ৫০টি বসতঘরে। ¶তিগ্নস্ত হয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকারও বেশি সম্পদ। আর সর্বশেষ শিকার হন লিটন নামের এক ব্যক্তি। এভাবে চলার পর ২০১৩ সালের নভে¤\^রে তৎকালীন শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজুর নির্দেশনায় স্থানীয় প্রশাসন দুই প¶ের মধ্যে আপস-মীমাংসা করে দিয়েছিলেন। দীর্ঘ চার মাস বিরতির পর তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই প¶ আবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এরপর দুই প¶ের নয় দফা সংঘর্ষে শতাধিক ব্যক্তি টেঁটাবিদ্ধ ও ককটেল বিস্ফোরণে আহত হন। একের পর এক টেঁটাযুদ্ধে গ্রামগুলো লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে। মানুষ জান ও মালের নিরাপত্তা হারিয়ে সার্ব¶ণিক উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। এ পর্যন্ত দুইপ¶ের হত্যা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণ মামলা ও পাল্টা মামলা হয়েছে ১৭টি। এসব মামলায় মধ্যে প্রায় ১০টিতেই আসামি করা হয় লাঠিয়াল সর্দার সুমেদ আলীকে। স্থানীয় লোকজন জানায়, এ সব মামলা থেকে র¶া পেতে সম্প্র্রতি সুমেদ আলী নিল¶া ইউনিয়নের নব্য আওয়ামী লীগ নেতা তাজুল ইসলামের প¶ে যোগ দেন। তাঁর ছত্রছায়ায় পা দেন টেঁটা শিকারি থেকে অবৈধ অস্ত্র ও ককটেল বিস্ফোরণের জগতে। গত ৭ মে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী তাজুল ইসলামের প¶ নিয়ে সকাল ১০টায় সুমেদ আলীর নেতৃত্বে দড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সব্দর আলী খান উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাদের দখলে নেয়। পরের দিন সকালে সুমেদ আলী ও তাঁর লোকজন স্থানীয় আতশ আলী বাজারে নিল¶া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হক সরকারের সমর্থক আনোয়ার হোসেনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করে মৃত ভেবে ফেলে চলে যায়। এ খবর পাওয়ার পর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হক সরকার ও বিজয়ী চেয়ারম্যান তাজুল ইসলামের প¶ের লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। তখন সাবেক চেয়াম্যানের বাড়িসহ ২০-২৫টি বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে প্রায় তিন কোটি টাকার মালামাল ¶য়¶তি হয়। এরপর থেকে দুই প¶ের লোকজনের মধ্যে চলে আসছে বিচ্ছিন্নভাবে সংঘর্ষ। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১ জুন সকালে পুনরায় লাঠিয়াল সর্দার সুমেদ আলীর লোকজন নিল¶া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হকের সমর্থক বীরগাঁও গ্রামের হারুন মিয়ার বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। এতে হক চেয়ারম্যানের লোকজন পাল্টা জবাব দিলে দুই প¶ের মধ্যে টেঁটাযুদ্ধ শুরু হয়। পরে ওই সংঘর্ষ পর্যায়ক্রমে আমিরাবাদ, সোনাকান্দি, হরিপুর, দড়িগাঁও ও গোপীনাথপুরসহ সাতটি গ্রামে দুই প¶ের সমর্থকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ককটেল বিস্ফোরণ ও টেঁটা-বল্লমসহ দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে উভয় প¶ের কমপ¶ে ২০ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে লিটন মিয়া নামের এক ব্যক্তি নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় লাঠিয়াল সর্দার সুমেদ আলীকে প্রধান আসামি করে নিহত লিটনের স্ত্রী শুক্কুরি বেগম বাদী হয়ে রায়পুরা থানায় একটি হত্যা মামলা ও উপপরিদর্শক (এসআই) মামুন বাদী হয়ে বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুটি মামলা করেন। তবু থামেনি সুমেদ আলীর টেঁটাযুদ্ধ। গত ৬ জুন তিনি লোকজন নিয়ে দেশীয় অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুনরায় সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার প্রস্তুতি নেন। খবর পেয়ে বিকেলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) জাকির হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালায়। পুলিশ গ্রামবাসীকে ছত্রভঙ্গ করতে ধাওয়া দেয়। এতে তাঁর বাহিনী ¶িপ্ত হয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। তারা পুলিশকে ল¶্য করে টেঁটা ও বল্লম ছুড়তে থাকে। এ সময় তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। পরে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন