শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

নরসিংদীতে ডাকাতির মামলার দুই এসআই’র বিরুদ্ধে যত অভিযোগ





নরসিংদী সংবাদদাতাঃ
নরসিংদীতে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতির ঘটনায় গ্রেফতার রায়পুরা থানার উপ-পরিদর্শক সাখাওয়াত হোসেন ও আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্যতা, গ্রেফতার বাণিজ্যসহ চরাঞ্চলের সহিংসতায় ইন্ধনসহ নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। তাদের এসব অপকর্মের সঙ্গে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যও জড়িয়ে পড়েছিলেন বলে জানা গেছে। সম্প্রতি চরাঞ্চলের সহিংসপ্রবণ এলাকা থেকে একাধিক ব্যক্তির গুম হওয়ার পেছনেও ওই পুলিশ সদস্যদের আঁতাত রয়েছে বলে ধারণা করছে এলাকাবাসী।

রায়পুরা উপজেলার চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার নানা অপকর্ম বেরিয়ে আসে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগীরা জানান, রায়পুরা থানায় যোগদানের পর থেকে উপ-পরিদর্শক সাখাওয়াত হোসেন ও আজহারুল ইসলাম বেপরোয়া গ্রেফতার বাণিজ্য শুরু করেন। বিনা অপরাধে সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করতেন তারা। অন্যথায় ইয়াবা মামলায় ফাঁসানো ও গুম করার হুমকি দিতেন। রায়পুরার চরাঞ্চলের বাঁশগাড়ী, নিলক্ষা, মির্জারচর, চর মধুয়া, পাড়াতলী, চাঁনপুর, শ্রীনগরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে বছরের পর বছর ধরে চলমান সহিংস ঘটনাকে পুঁজি করে তারা গ্রেফতার বাণিজ্য চালিয়ে আসছিলেন। চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে না পারলে গ্রেফতার অথবা ভয় দেখিয়ে এলাকা ছাড়া করতেন। টাকার বিনিময়ে  টেঁটাযুদ্ধ ও লুটপাট করার সুযোগ করে দিতেন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঈদুল আযহার আগে উপ-পরিদর্শক সাখাওয়াত হোসেন চরাঞ্চলের মেঘনা নদীতে গরুর হাট থেকে ফেরার পথে ৩০ গরু ব্যবসায়ীকে জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে ৭০ লাখ টাকা ও ২৫টি গরু লুট করেন। সেসময় রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দেলোয়ার হোসেন প্রায় ৯ লাখ টাকা ও ২৫টি গরু জব্দ করার কথা গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে স্বীকারও করেছিলেন। তবে গরু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে টেঁটাযুদ্ধের প্রস্তুতির অভিযোগ তুলেছিল পুলিশ। পরে ৩০ গরু ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজনকে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়ে বাকিদের বিরুদ্ধে টেঁটাযুদ্ধের মামলা দিয়ে আদালতে পাঠায় থানা পুলিশ। ওই গরু ব্যবসায়ীরা আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পেলেও লুট হওয়া টাকা ফেরত পাননি। টাকা ও গরু লুটের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হলে তদন্তে নামে ঊর্ধ্বতন কর্তৃক্ষ। যার তদন্ত এখনও চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রায়পুরার তুলাতুলী এলাকার এক ওষুধ ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, গত ২ ডিসেম্বর রাতে তার বাড়িতে হানা দেয় উপ-পরিদর্শক সাখাওয়াত হোসেন ও তার সহযোগীরা। এ সময় তারা ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বিক্রির অভিযোগ তুলে মামলার ভয় দেখিয়ে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। পুলিশি হয়রানি এবং মান-সম্মান থেকে বাঁচতে ধার-দেনা করে দুই দফায় চার লাখ টাকা দিতে বাধ্য হন।
অভিযোগ রয়েছে, গত ১৪ ডিসেম্বর রাতে উপ পরিদর্শক সাখাওয়াত হোসেন উপজেলার নিলক্ষা ইউনিয়নের আমিনুল ইসলাম খোকা নামে এক ব্যবসায়ীকে মামলা ছাড়াই নরসিংদী শহর থেকে আটক করেন। এ সময় তার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। অন্যথায় ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে স্বজনদের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা আদায় করা হয়। কিন্তু টাকা নেওয়ার পরও তাকে একটি হত্যা মামলায় জড়িয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। পরে আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হন ওই ব্যবসায়ী।
এছাড়া অপর উপ-পরিদর্শক (এসআই) আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অপকর্মের অভিযোগ। প্রায় এক বছর আগে নিলক্ষা ইউনিয়নের এক শ্রমিককে কারখানায় যাওয়ার পথে আটক করেন ওই এসআই। এ সময় টাকা দিতে না পারায় তার বিরুদ্ধে বিস্ফোরক মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।
সম্প্রতি পুলিশ পরিচয়ে বাঁশগাড়ী ইউনিয়নে চার জন ও নিলক্ষা ইউনিয়নে দুজনকে উঠিয়ে নেওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত তাদের খোঁজ পাচ্ছেন না পরিবারের লোকজন। ঘটনার পর থেকে পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের উঠিয়ে নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করা হচ্ছিল। কিন্তু এসব ব্যক্তি নিখোঁজ হওয়ার পেছনে উপ-পরিদর্শক সাখাওয়াত ও আজহারুল জড়িত বলে ধারণা করছে এলাকাবাসী।
এদিকে গত ২৬ জানুয়ারি রাতে মালয়েশিয়া প্রবাসী নরসিংদীর রায়পুরার হাইরমারা এলাকার সোহেল মিয়া একটি ভাড়া গাড়িতে চার স্বজনের সঙ্গে বাড়ি ফিরছিলেন। গাড়িটি নরসিংদীর সাহেপ্রতাব এলাকায় একটি সিএনজি ফিলিং স্টেশনে গ্যাস নেওয়ার জন্য থামে। এ সময় একটি মাইক্রোবাস থেকে নেমে উপপরিদর্শক সাখাওয়াত ও আজহার আলীসহ ৪/৫ জন নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে সোহেলের গাড়িতে অবৈধ মালামাল রয়েছে বলে দাবি করেন। পরে তল্লাশির নামে সোহেলের কাছ থেকে দু’টি স্বর্ণের বার, স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল সেটসহ প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নেন। এ ঘটনায় প্রবাসী সোহেলের স্বজন শাহজাহান মিয়া লিখিতভাবে জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে জানান। গোয়েন্দা পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে সিএনজি স্টেশনের সিসি টিভির ফুটেজ দেখে ঘটনার সত্যতা পান এবং রায়পুরা থানার চার পুলিশসহ অন্য তিন আসামিকে শনাক্ত করেন। এরপর গত ৩০ জানুয়ারি শাহজাহান মিয়া বাদী হয়ে সদর মডেল থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় এসআই সাখাওয়াত হোসেন, এসআই  আজহারুল ইসলাম, কনস্টেবল মাইনুল ইসলাম, সাইদুল ইসলাম, গাড়িচালক নুরুজ্জামান মোল্লা  এবং সহযোগী নূর মোহাম্মদ ও সাদেক মিয়াকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। এ সময় লুট হওয়া ১০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের বার, নগদ ২৯ হাজার ২৫৫ টাকা ও তিন রাউন্ড গুলিসহ একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়।  বুধবার (৩১ জানুয়ারি) তাদের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
এব্যাপারে নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ শফিউর রহমান সাংবাদিকদের জানান, আইনের ঊর্ধে কেও নয়। অভিযোক্ত পুলিশদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন